Hsrf_logo

HSRF – Homoeopathy Study And Research Foundation

একজন নারীর গর্ভাবস্থার প্রথম দিকের সমস্যা ও করনীয়গুলি কয়েকটি ধাপে উল্লেখ করা হলো:
প্রত্যেকটি নারীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হচ্ছে অন্তঃসত্ত¡া মুহূর্ত। গর্ভধারণের প্রথম সময়টায় নারীদের শরীরে নানা উপসর্গ দেখা দেয়। গর্ভধারণের লক্ষণ সবার ক্ষেত্রে সমান হয় না।

ক. গর্ভের প্রথম সপ্তাহে কিছু লক্ষণ:
গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় প্রথম সপ্তাহে কিছু লক্ষণ কমবেশি সব নারীর ক্ষেত্রে দেখা যায়। লক্ষণগুলো হলো, যথা-
১. রক্তক্ষরণ ঋতুচক্রের মতোই ৬ থেকে ১২ দিন হালকা রক্তপাত হতে পারে। এই লক্ষণ দেখলে প্রেগন্যান্সি পরীক্ষা অবশ্যই করে নিতে হবে।
২. প্রথম সপ্তাহে মুখে অন্য রকম স্বাদ অনুভব করবে। অনেক সময় মুখে দুর্গন্ধও হতে পারে। আসলে গর্ভাবস্থার ফলে শরীরে হরমোনের মাত্রার তারতম্যের কারণেই এই তফাৎ হতে পারে।
৩. গর্ভে সন্তান এলে নারীরা অতিরিক্ত পরিমাণে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। তিনি গর্ভবতী হয়েছেন এমন স্বপ্নই দেখেন তারা।
৪. গর্ভাবস্থার সময় শরীর অতিরিক্ত পরিমাণ তরল উৎপাদন করে। আর তার ফলে কিডনি দ্বিগুণ পরিমাণে কাজ করে। আর সে কারণেই অতি ঘন ঘন শৌচাগারে যাওয়ার প্রয়োজন হয়।
৫. গর্ভাবস্থায় মাথার যন্ত্রণা হতে পারে। গর্ভধারণ করার প্রথম সপ্তাহের শুরুতেই মাথাব্যথা শুরু হতে থাকে। হরমোনের মাত্রা শরীরে বেড়ে যাওয়ার কারণেই এ সমস্যা হয়।

খ. গর্ভের প্রথম মাসের কিছু লক্ষণ:
গর্ভাবস্থায় প্রথম মাসে একজন মহিলা নিম্নলিখিত লক্ষণ এবং উপসর্গগুলি অনুভব করতে পারে:
১. ঋতুস্রাবের অনুপস্থিতি
২. বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া
৩. স্তনে কোমলতা
৪. অনেক সময় মুখে বা হাত-পায়ে কালো কালো ছোপ ছোপ দাগ দেখা য়ায়। গর্ভধারণের সময় ত্বকের সংবেদনশীলতা বেড়ে যায়। এর ফলে চেহারায় এই কালো দাগ-ছোপ দেখা যায়।
৫. ঘন ঘন মেজাজ পরিবর্তন
৬. অত্যন্ত শারীরিক ক্লান্তি দেখা দিতে পারে
৭. ঘন মূত্রত্যাগ হতে পারে
৮. অ্যাসিড রিফ্লাক্সের কারণে অম্বল বা গ্যাস হতে পারে
৯. খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন দেখা দিতে পারে
১০. গন্ধ অনুভূতির বৃদ্ধি, অর্থাৎ যে কোন গন্ধ অত্যানুভূতিযুক্ত হতে পারে
১১. বিচলিত বোধ করা
১২. নির্দিষ্ট কিছু খাবারের প্রতি সংবেদনশীলতা হতে পারে
১৩. মাথায় ভারবোধ অনুভব করা
১৪. মাথা ঘোরানো অনুভব করা
১৫. পিঠে প্রচন্ড ব্যথা হওয়া
১৬. ক্ষুধা বৃদ্ধি পাওয়া
১৭. কোষ্ঠকাঠিন্যতা বা মলত্যাগ পরিষ্কার না হওয়া
১৮. অন্ত্রের অনিয়মিত চলাচল।
১৯. অনিন্দ্র বা বেশি নিদ্রা
২০. ক্লান্তি গর্ভাবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য লক্ষণ। যেহেতু শরীর এই সময় বাড়ন্ত শিশুকে পুষ্টি দেয়ার জন্য অতিরিক্ত রক্ত উৎপন্ন করে তার ফলে খুব অল্পতেই ক্লান্তি এসে যায়।
২১. শীত শীত ভাব অনুভব করা।
গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে এই সবকয়টি লক্ষণ এবং উপসর্গ একজন মহিলার মধ্যে ঘটে না, তবে সব মহিলাদের মধ্যে এই লক্ষণগুলির একটি বা একাধিক পাওয়াটাই স্বাভাবিক।

গ. গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে একজন মহিলার শারীরিক পরিবর্তনগুলি:
গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে নিম্নলিখিত শারীরিক পরিবর্তনগুলি দেখা যেতে পারে, যদিও কিছু মহিলারা গর্ভাবস্থার পরেই এই পরিবর্তনগুলি লক্ষ্য করতে পারে, যেমন-
১. যোনি স্রাব বৃদ্ধি হওয়া
২. মানসিকভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে
৩. মাথা ঘোরানো
৪. ক্লান্ত এবং দুর্বল বোধ করা
৫. স্তনের আকার পরিবর্তন, অর্থাৎ স্তন বড় হওয়া
৬. স্তনের চারপাশের এলাকা বড় এবং ডার্ক হতে পারে
৭. চর্মে হালকা দাগ পড়া
৮. ওজন বৃদ্ধি হওয়া

ঘ. গর্ভকালীন বয়স:
একজন মহিলার শেষ মাসিকের প্রথম দিন থেকে গর্ভাবস্থার সময় গণনা করা হয়। এটি গর্ভকালীন বয়স বা সময় হিসেবে পরিচিত। কিন্তু, একটি শিশু সাধারণত তার মাত্র ১৫ দিন পরে গর্ভবতী হয়। অতএব, যদিও গর্ভাবস্থা প্রায় এক মাস বয়সী, তবুও শিশুর বয়স প্রায় দুই সপ্তাহ। তাই গর্ভকালীন সময়ের তুলনায় শিশু সবসময় ছোট থাকে।

ঙ. গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে ভ্রূণ যে ভাবে বিকশিত হয়:
গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে, নিম্নলিখিত উপায়ে ভ্রূণের বিকাশ ঘটে-
১. সহবাসের পর, গর্ভাধান প্রক্রিয়া কয়েক ঘন্টার মধ্যে হতে পারে। যখন মহিলা ডিম্বাণু এবং পুরুষ শুক্রাণু পরস্পরের সংস্পর্শে আসে, তখন নিষেক প্রক্রিয়া শুরু হয়, যার ফলে একটি জাইগোট তৈরি হয়।
২. একবার জাইগোট তৈরি হয়ে গেলে, এটি একটি মহিলার ফ্যালোপিয়ান টিউবের মাধ্যমে জরায়ুতে প্রবেশ করে। এটি পুঞ্জীভূত পেশীগুলির মধ্যে বিভক্ত হতে শুরু করে এবং পুষ্টি পেতে জরায়ুর প্রাচীরের সাথে সংযুক্ত হয়। এই ধাপটি ইমপ্লান্টেশন নামে পরিচিত, এবং এই সময় শিশুটি ভ্রূণ হিসাবে পরিচিত হয়। গর্ভধারণের দ্বিতীয় মাসের শেষ অবধি ভ্রূণ ভ্রূণে পরিণত হলে শিশুটি ভ্রূণ হিসেবে পরিচিত।
৩. প্লাসেন্টা নামে পরিচিত একটি অঙ্গের গঠন জরায়ুতে দেখা যায়। গর্ভাবস্থায় নারীর জরায়ুতে প্লাসেন্টা বিকশিত হয় এবং জরায়ুর দেয়ালে সংযুক্ত থাকে। এটি ক্রমবর্ধমান শিশুর পুষ্টি এবং অক্সিজেন সরবরাহের মাধ্যম এবং শিশুর রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থও সরিয়ে দেয়। বাচ্চার নাভির দড়ি(শিশুকে মায়ের সাথে সংযোগকারী নল) প্লাসেন্টা থেকে উদ্ভূত হয়।
৪. গর্ভাবস্থার তৃতীয় এবং চতুর্থ সপ্তাহে, শিশুর হৃদস্পন্দন শুরু হয়। এই সময়ের মধ্যে, ভ্রূণ একটি মটরের আকার নিয়েছে (মাত্র ৬ থেকে ৭ মিলিমিটার আকারের), কিন্তু ফুসফুস, হাত এবং পায়ের বিকাশ শুরু হয়। এর পরে, চোখ, কান, নাকের পরে মুখের বিকাশ শুরু হয়। গর্ভাবস্থার তৃতীয় সপ্তাহে শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয়।

চ. গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে যে সকল পরীক্ষা করা উচিত:

প্রাইমারী পরীক্ষা:
১. যদি কোনও মহিলার গর্ভাবস্থার সন্দেহ হয়, তবে তিনি পরীক্ষার জন্য ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
২. ডাক্তার প্রথমে একটি শারীরিক পরীক্ষা করবেন যাতে মহিলার যোনি, জরায়ু এবং জরায়ু পরীক্ষা করার জন্য একটি পেলভিক পরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত থাকে।
৩. ডাক্তার মহিলার পারিবারিক ইতিহাসও নেবেন এবং মহিলার স্বাস্থ্যের মূল্যায়ন করবেন, যার মধ্যে মহিলার উচ্চতা, ওজন, রক্তচাপ রয়েছে।
৪. যে কোন পূর্ব-বিদ্যমান চিকিৎসা শর্ত বা যে কোন ওষুধ যে মহিলা গ্রহণ করছে তা ডাক্তারকে জানানো উচিত।

নিশ্চিত পরীক্ষা:
গর্ভাবস্থা নিশ্চিত করতে এবং গর্ভাবস্থায় কোন সম্ভাব্য সমস্যা সনাক্ত করার জন্য ডাক্তার
নিম্নলিখিত পরীক্ষার পরামর্শ দেবেন-
১. HCG (হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন হরমোন যা প্লাসেন্টা দ্বারা উৎপাদিত হয়)হরমোনের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য প্রস্রাবের নমুনা গ্রহণ করে একটি গর্ভাবস্থা পরীক্ষা করা হয়। এটি গর্ভাবস্থা নিশ্চিত করে।
২. নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা এবং প্রস্রাব পরীক্ষা করা যেতে পারে।
৩. গর্ভাবস্থা নিশ্চিত করতে ডাক্তার সিরাম প্রোজেস্টেরন পরীক্ষা করতে পারে।
৪. গর্ভাবস্থা সনাক্ত করতে ডাক্তার আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান করতে পারেন।
৫. গর্ভাবস্থায় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এমন কারণ খুঁজে বের করার জন্য একটি প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট (সাধারণত সার্ভিকাল ক্যান্সার পরীক্ষা করার জন্য করা হয়)করা হয়।

ছ. গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে যে সকল বিষয়গুলো সর্তকতা মূলক স্বরণ রাখতে হবে:
১. আপনার ডায়েটে ভিটামিন এবং খনিজ সমৃদ্ধ খাবার অন্তর্ভুক্ত করুন।
২. গর্ভাবস্থায় প্রচুর পরিমাণে তরল এবং জল পান করুন।
৩. গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন কিছু হালকা ব্যায়াম করা উচিত যদি না জটিল গর্ভাবস্থার কারণে ডাক্তার এর বিরুদ্ধে পরামর্শ না দেয়।
৪. পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমান।
৫. ধূমপান ও মদ্যপান পুরোপুরি ছেড়ে দিতে হবে।
৬. গর্ভাবস্থায় আপনার যোনিতে সংক্রমণ রোধ করতে যোনির যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখুন।
৭. ভিটামিন এবং আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হবে।
৮. গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে সঙ্গম থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।
৯. অধিক ভ্রমণ বর্জনীয়।
১০. ঠান্ডা লাগা বা অসুস্থ হতে পারে এমন কাজ ও খাবার গ্রহণ না করা।
১১. এই সময় যে কোন প্রকার শারীরিক সমস্যা দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

জ. যে সকল জটিলতার জন্য দ্রæত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে:
১. কিছু উপসর্গ একটি সংক্রমণ, এমনকি একটি গর্ভপাত বা একটি অস্থির গর্ভাবস্থা(টিউবাল প্রেগন্যান্সি) নির্দেশ করতে পারে।
২. পেটে তীব্র ব্যথা দেখা দিলে।
৩. পেটে তীব্র খালধরা বা খিচে ধরলে।
৪. জ্বর হলে।
৫. তীব্র বমি বমি ভাব হলে।
৬. তীব্র বমি হলে।
৭. যোনি রক্তপাত যা উজ্জ্বল লাল রঙের বা অত্যধিক রক্তপাত একটি প্যাড সম্পূর্ণভাবে ভিজিয়ে দেয় এমন হলে।
৮. গুরুতর মাথাব্যথা এবং মাথা ঘোরা থাকলে।
৯. প্রস্রাব করার সময় জ্বালা অনুভূতি বা ব্যথা মূত্রনালীর সংক্রমণের ইঙ্গিত দিতে পারে।

ঝ. চিকিৎসা:
গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে প্রধান সমস্যা বমি বমি ভাব বা বমি, এই বমির চিকিৎসা করা হোমিওপ্যাথিতে সবচেয়ে বেশি সহজ।
হোমিওপ্যাথিতে বমি বমি ভাব ওষুধ রয়েছে ৫৫টি, আর বমিতে রয়েছে ৬৯টি। এই সবগুলি ওষুধের বমি ও বমি বমি ভাবের লক্ষণসহ ব্যবহার আমার লেখা হোমিওপ্যাথিক মেটেরিয়া মেডিকাতে উল্লেখ রয়েছে।

লেখক- ডা. ফারুকী
০১৭১১০৩৯২৩৯